উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিরাপদ খাদ্যের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
দেশে প্রাপ্ত সকল খাদ্যই নিরাপদ হবে, দেশের সব মানুষই নিশ্চিত নির্ভরতায় নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় এই অগ্রাধিকার এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে খাদ্য উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্য সংগ্রহোত্তর অব্যবস্থাপনা, সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করা, রান্না বা প্রক্রিয়াজাতকরণে স্বাস্থ্যসম্মত বিধান অনুসরণ না করা, প্রক্রিয়াজাতকরণে বিভিন্ন অনিরাপদ রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার এবং সর্বোপরি পরিবেশন স্তরেও নিরাপদতার মানদন্ড অনুসৃত না হবার ফলে খাদ্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। সাথে সাথে খাদ্যের পুষ্টিমান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মানুষ কষ্টের টাকায় খাবার কিনেও একদিকে পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দূষিত বা অনিরাপদ খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়, অসুস্থতায় কমছে উৎপাদনশীলতা এবং ব্যাহত হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের শুভযাত্রা! এই অব্যবস্থাপনার পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্যথায় উন্নয়নের কাঙ্খিত সুফল মানুষ পাবে না, পিছিয়ে যাবে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।
বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিগত দেড়-দুই দশকে বাংলাদেশ অবকাঠামোগত উন্নয়নে খুব বড় বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে। পদ্মা ব্রীজ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, উপকূলীয় অঞ্চলে নানাবিধ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ‘রোল মডেল’। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষ এই অভূতপূর্ব উন্নয়ন সূচনার জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। যত সমালোচনাই থাকুক, মানুষ এই অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগকে স্বাগত ও সাধুবাদ জানাচ্ছে। মানুষ মাত্রই উন্নয়ন পিয়াসী এবং সেটা দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন। মানুষকে সম্পৃক্ত করে বা অবহিত রেখে উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা সরকারের জন্য আরও ফলপ্রসু হতে পারে। আশাকরি, সংশ্লিষ্ট মহল বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন অভিযাত্রাকে স্বাগত জানানো সত্বেও বাংলাদেশের মানুষ এখনও যে বিষয়টিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সেটা হলো নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। সবাই জানেন, বাংলাদেশে এখন আর খাদ্যের অভাব নেই। বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের কৃষিতে বিজ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার, যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধি এবং সঠিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষি অর্থনীতি হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ের অন্যতম আরেকটি উৎস। এর ফলে প্রান্তজনীয় কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলেই অর্থনৈতিকভাবে সৃমদ্ধি অর্জন করবেন। ‘কৃষিই সমৃদ্ধি’ সেই শ্লোগানটি তখন বাস্তব হয়ে অন্যকে পথ দেখাবে। দেশের তরুণ উদ্যোক্তাগণ খাদ্য ও কৃষিতে মনযোগ দিবে এবং বাড়বে আত্মকর্মসংস্থান। কমে আসবে বেকারত্ব। কিন্তু উৎপাদিত খাদ্যপণ্য যদি নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ না হয়, তাহলে খাদ্য রপ্তানীর স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। দেশের ভেতরেও অনিরাপদ খাদ্য খেয়ে মানুষ দীর্ঘমেয়াদী নানা ধরণের জটিল রোগের শিকার হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দেরীতে হলেও এখন ওষুধের সাথে রোগীদেরকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত, ফ্রেশ খাবার গ্রহণের তাগিদ দিচ্ছেন। এই ধারায় গতি বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে গণমাধ্যমের সরব ভূমিকা জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভোক্তার আগ্রহ তৈরীতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এর জন্য কাজ করা দরকার।
বাংলাদেশে নগরায়ন দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে গ্রামীণ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কি ধরণের অভিঘাত সৃষ্টি করবে সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। কেমন হবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনা? নিঃসন্দেহে মানুষ তখন প্যাকেটজাত খাবার, দোকানের খাবার অনেক বেশি খাবে। বেড়ে যাবে পথখাবার গ্রহণকারীর সংখ্যাও। সেই খাবার নিরাপদতা এবং পৃষ্টিমান নিশ্চিত করার জন্য সরকার কতটুকু সফল এবং আরও কী করা প্রয়োজন সেটা নিয়ে সর্বস্তরে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন মেগা প্রকল্প গ্রহণ করছে কিন্তু নিরাপদ খাদ্যের ভ্যালুচেইন (ক্ষেত থেকে পাত পর্যন্ত) উন্নয়নে অর্থাভাব রয়েছে অজুহাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অতি জরুরী কাজগুলো করা সম্ভব হচ্ছে। খাদ্যমান পরীক্ষক এবং খাদ্যমান পরীক্ষাগার এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। মান নিয়ন্ত্রণে জোরালো অবস্থান উৎপাদন পর্যায়ে গুণগত পরিবর্তন আনয়ন করবে। আমাদের দেশের ওষুধ এবং তৈরী পোশাক শিল্পে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে। খাদ্যের ক্ষেত্রেও সর্বস্তরে কঠোর মান নিয়স্ত্রণ ও পরীবিক্ষণ ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য মনে করি। এর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নিরাপদ ও পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য নিশ্চিত করার প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হয়েছে। কিন্তু সেই কর্তৃপক্ষের কার্যাবলী এখনও জনসন্তষ্টি সৃষ্টি করতে পারেনি। কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা নিয়েও ব্যাপক অসন্তোষ বিদ্যমান। সেখানে নিয়োগ পাওয়া ফুড সেফটি কর্মকর্তাগণ পরবর্তিতে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে অন্যত্র বদলী হয়ে যাচ্ছে ফলে প্রশিক্ষিত জনবলের ঘাটতি কমছেই না। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হবে শুনে আসছি কিন্তু সেটা অগ্রগতি খুব ধীর। সম্প্রতি সরকার ফল রপ্তানীর সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে ‘উত্তম কৃষি চর্চা’ নামের একটি নীতিমালা তৈরী করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে দেয়া হয়েছে সেই নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব। শুধুমাত্র ফল এর জন্য এটা হয়তো সঠিক কিন্তু ঐ ফল প্রক্রিয়াজাত করে যখন নতুন একটি পণ্য উৎপাদিত হবে তখন সেই পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর করতে পারবে না। যেমন ধরুন নিরাপদ টমেটো উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিন্তু টমেটো দিয়ে যখন কেচাপ তৈরী হবে তখন সেটার মান নিয়ন্ত্রণ এর দায়িত্ব বর্তাবে বিএসটিআই এর উপর যা কিনা অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের অধীন। উৎপাদিত কেচাপ এর মান ঠিক আছে কিনা বা সেটি স্বাস্থসম্মত উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব আবার অন্য আরেকটি কর্তৃপক্ষের। ফলে এখানে সমন্বয়ের সমস্যা হবে এবং সেটা আমার প্রত্যক্ষ করছি। এই ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হচ্ছে, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় এফডিএ বা ‘ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিষ্ট্রেশন’ এর ন্যায় একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সংস্থা গড়ে তোলা। যতটুকু জানি, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর আওতায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠনের বিধানটিও সেই লক্ষ্য থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছিল কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেটা করা সম্ভব হচ্ছে। কে কার অধীনস্ত, কর্তৃত্ব কার বেশি ইতাদি নানা প্রশ্নে আমরা দেশের বর্তমান খাদ্য শৃঙ্খলে নিয়োজিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন সমন্বয় দেখছি না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারর শুভ আকাঙ্খা এবং জনগণের নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার।
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ তাই খুব স্পষ্ট করে দাবী জানাচ্ছে;
১. বিদ্যমান ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ সংশোধনপূর্বক সময়োপযোগী করতে হবে।
২. নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সংস্থায় (এফডিএ’র ন্যায়) রূপান্তর করতে হবে।
৩. নিরাপদও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন থেকে ভোক্তার পাত পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো ভ্যালু চেইনে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. দেশের তরুণদেরকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ভ্যালু চেইনে সম্পৃক্ত করার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
৬. নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আন্তঃ সমন্বয় জোরদার করতে হবে।
৭. খাদ্যের নিরাপদতা ও পুষ্টিমান বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় রেখে দেশের বাজারগুলির অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে
৮. দেশের সকল হোটেল-রেঁস্তোরা, খাবারের দোকান তথা খাদ্য ব্যবসায় জড়িতদের লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে তালিকাবদ্ধ করা এবং তাদের মধ্যে খাদ্যের নিরাপদতা ও পুষ্টিমান বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা। অসাধু ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখতে হবে।
৯. খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা এবং বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ বিধিমালাসহ প্রণীত সকল বিধিমালার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
খাদ্য দূষণ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মাত্রায় ও ধরণে আমাদের মাঝে ফিরে আসছে। অজ্ঞতাজনিত রাসায়নিক দূষণ ছাড়াও জ্ঞাতভাবে একদল অসাধু মানুষ খাদ্যদ্রব্যকে দূষিত করছে। অনিয়ন্ত্রিত মুনাফার লোভ খাদ্যকে অখাদ্যে পরিণত করছে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতি মায়েদের খাবার, বয়স্কদের খাবার এবং রোগীদের খাবারে দূষণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে ফেলছে। খাদ্য দূষণে কোন অবহেলা বা উদাসীনতা দেখানোর কোন সুযোগ নেই। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। নাগরিক আন্দোলন শক্তিশালী হলে সরকারও এ বিষয়ে মনযোগ বৃদ্ধি করবে। নাগরিক সমাজ মনে করে, উন্নয়ন পরিকল্পনায় নিরাপদ খাদ্যের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার বৃহত্তর লক্ষ্যকে সামনে রেখে অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাংলদেশের সকল খাবারের মান নিশ্চিত রাখতে সরকারকে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক:
আতাউর রহমান মিটন
কান্ট্রি ডিরেক্টর, হাঙ্গার ফ্রী ওয়ার্ল্ড ও চেয়ারম্যান, বিকশিত বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন
younus / younus