১৯১৩ সালের ১১ জুন। দিনটি ছিল বুধবার।
কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমানে তুরস্কের ইস্তাম্বুল) ওসমানি সাম্রাজ্যের যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছিলেন গ্র্যান্ড ভাইজার (প্রধানমন্ত্রীর সমকক্ষ) মাহমুদ শেবকাত পাশা। পথে আততায়ীর গুলিতে খুন হন। গ্র্যান্ড ভাইজারের পাশাপাশি তিনি ছিলেন ওসমানি সাম্রাজ্যের যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীও।
মাহমুদ শেবকাত পাশাকে বহনকারী গাড়িটি ছিল ছাদখোলা। তখন পুরো শহরে এমন গাড়ি ছিল মাত্র ১০০টি। শহরের ব্যস্ততম এলাকা দিভান ইয়োলু অ্যাভিনিউয়ে গিয়ে শেবকাত পাশার গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায়। এরপর গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন চালক। নেমে তিনি গাড়ি মেরামত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।
এমন সময় শেবকাত পাশার গাড়ির পাশে এসে থামে আরেকটি গাড়ি। সে গাড়িতে ছিল দুই ব্যক্তি। তাদের হাতে ছিল একটি করে রিভলভার। দুজনই শেবকাত পাশা ও তাঁর উপদেষ্টা ইব্রাহিম বেকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে।
আততায়ীরা গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত দেয়নি। এরপর গাড়ি থেকে নেমে আসে তারা। চেপে বসে শেবকাত পাশার গাড়িতে। পরে আরও ১০টি গুলি ছুড়ে সেই গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। জীবনাবসান ঘটে রাষ্ট্রনেতা ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সমরনায়ক শেবকাত পাশার।
মৃত্যুর আগে শেবকাত পাশার শেষকথা ছিল, ‘আমার দেশ, আহা আমার প্রিয় দেশ!’
ক্যাপ্টেন থেকে গ্র্যান্ড ভাইজার
১৮৫৮ সালে বাগদাদে জন্ম মাহমুদ শেবকাত পাশার। কনস্টান্টিনোপলের একটি ক্যাডেট স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষে ১৮৮২ সালে স্টাফ ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। তিনি যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জেনারেল স্টাফও ছিলেন। ১৮৮৬ সালে কমিশন পেলে জার্মানিতে তাঁকে নিয়োগ দেয় ওসমানীয় সেনাবাহিনী।
জার্মানিতে ওসমানীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদন দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন শেবকাত পাশা। জার্মানি থেকে ফেরার পর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর পরিদর্শন ও নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পান তিনি।
১৯০৮ সালের ‘তরুণ তুর্কি বিপ্লবের’ পর সালোনিকায় (থেসালোনিকি, বর্তমানে গ্রিসে) ওসমানীয় সেনাবাহিনীর থার্ড আর্মির কমান্ডারের দায়িত্ব পান শেবকাত পাশা। এই দায়িত্বে থাকার সময় তরুণ তুর্কি বিপ্লবের বিরুদ্ধে একটি ধর্মীয় আন্দোলন দমনে ভূমিকা পালন করেন তিনি। ওই আন্দোলন ‘৩১ মার্চের ঘটনা’ নামে পরিচিত।
এই সময় রাজতন্ত্রের সমর্থক সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। শেবকাত পাশা এরপর প্রথম তিনটি আর্মি কোরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পান। এরপর হন যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। যুদ্ধমন্ত্রী থাকার সময়ে তাঁর ক্ষমতা সংহত হতে থাকে।
১৯১৩ সালের জানুয়ারিতে এনভার পাশার নেতৃত্বে একদল সেনা কর্মকর্তা লিবারেল ইউনিয়ন পার্টির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে কমিটি অব ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেস (সিউপি)। শেবকাত পাশা হন গ্র্যান্ড ভাইজার।
‘অনিবার্য’ পরিণতি
তুরস্কে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা ছিল শেবকাত পাশার। প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যায়, ওসমানীয় সাম্রাজ্যের এ জ্যেষ্ঠ নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছিল ইউরোপ। পাশে দাঁড়িয়েছিল ওসমানি সাম্রাজ্যের নেতারা।
তবে আততায়ীর হাতে শেবকাত পাশার খুন হওয়ার ঘটনায় অবাক হওয়ার মতো কিছু ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। একের পর এক ঘটে চলছিল এমন হত্যাকাণ্ড।
এর কয়েক মাস আগে এক নৈরাজ্যবাদীর হাতে নিহত হন গ্রিসের রাজা জর্জ। এ ছাড়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের গ্র্যান্ড ভাইজারদের এমন করুণ পরিণতির ইতিহাস ছিল দীর্ঘদিনের। পূর্বসূরিদের মতো শেবকাত পাশাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়।
]ধারণা করা হয়, এর আগের যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নাজিম পাশার হত্যার বদলা ছিল শেবকাত পাশার হত্যাকাণ্ড। ১৯১৩ সালের জানুয়ারির সেই অভ্যুত্থানে নিহত হন নাজিম পাশা। একটি সংবাদপত্রে এ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা করা হয়েছিল এভাবে, ‘নাজিম পাশাকে খুনের পর শেবকাত পাশার মৃত্যু পরোয়ানা লেখা হয়ে গিয়েছিল।’
শত্রু নাকি মিত্ররা নেপথ্যে
শেবকাত পাশার হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। প্রথম প্রশ্নটি উঠেছিল তাঁর চালককে নিয়ে। সেদিন আততায়ীর গুলিতে এক সহযোগীসহ শেবকাত পাশা নিহত হলেও অক্ষত ছিলেন গাড়ির চালক। আরেকটি রহস্যজনক বিষয় ছিল সেই গাড়িতে থাকা তৃতীয় ব্যক্তি। রহস্যজনকভাবে সে ব্যক্তি পালাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন।
এশরেফ বে নামে পালিয়ে যাওয়া সেই ব্যক্তি একবার নয়, দুবার পিস্তল দিয়ে আততায়ীদের লক্ষ্য করে গুলে করেন। দুবারই তাঁর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ঘটনাটা ছিল রহস্যজনক। ১৯১৩ সালের ২৪ জুন হত্যার ঘটনায় ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
শেবকাত পাশাকে যে–ই হত্যা করুক, তাঁর হত্যাকাণ্ডকে ক্ষমতাসীন সিইউপির সরকার অর্থাৎ তরুণ তুর্কি বিপ্লবের ওপর বড় এক আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, শেবকাত পাশার সুনাম ও সম্মানে ভর করেই সিইউপির সরকার চলছিল।
প্রথম বলকান যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ওসমানি সাম্রাজ্য সামরিক বাহিনীতে সংস্কার আনার চেষ্টা চালাচ্ছিল। শেবকাত পাশার হত্যাকাণ্ড ওসমানি সাম্রাজ্যের সে চেষ্টাতেও বড় ধরনের একটি আঘাত বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এসব সমসাময়িক বিশ্লেষণও অবশ্য ভুল হতে পারে। শেবকাত পাশার মৃত্যুর পরে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের ‘ত্রয়ী’ হিসেবে পরিচিত এনভার পাশা, তালাত পাশা ও জেমাল পাশা সিউপির একজন মিসরীয় সদস্যকে গ্র্যান্ড ভাইজারের মতো পদে নিয়োগ দেন। তাঁকে নামমাত্র গ্র্যান্ড ভাইজার করে ক্ষমতা নিজেদের কবজায় রাখেন এই ত্রয়ী।