এশিয়ার চালের বাজারে চলতি সপ্তাহে মিশ্র প্রবণতা তৈরি হয়েছে। শীর্ষ রফতানিকারক ভারতে শস্যটির রফতানি মূল্য বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমেছে থাইল্যান্ডে। তবে ভিয়েতনামিজ চালের রফতানি মূল্য আগের মতোই অপরিবর্তিত আছে। খবর রয়টার্স।
চলতি সপ্তাহে ভারত প্রতি টন ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল ৫৫০-৫৫৮ ডলারে রফতানি করছে। গত সপ্তাহে এ চালের দাম ছিল ৫৪৩-৫৫০ ডলার। মার্চের শুরুর দিকে প্রতি টনের মূল্য উঠেছিল ৫৬০ ডলারে, যা ছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল রফতানিতে বড় অংকের শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণেই মূলত চলতি সপ্তাহে দাম বেড়েছে। সরকার বর্তমানে ২০ শতাংশ রফতানি শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে ফি অন বোর্ডের পরিবর্তে মোট লেনদেন মূল্যকে বিবেচনা করছে। এ কারণে আমাদের বাধ্য হয়েই দাম বাড়াতে হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে ভারত সরকার সেদ্ধ চাল রফতানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল রফতানিকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা।
বেশ কয়েকজন রফতানিকারক জানান, গত ১৮ মাস পরিবর্তিত শুল্ক ব্যবস্থার কারণে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে পঙ্গু হতে বসেছে ভারতের চাল রফতানি খাত।
অন্য শীর্ষ রফতানিকারক থাইল্যান্ড চলতি সপ্তাহে প্রতি টন ৫ শতাংশ ভাঙা চাল ৫৮৫-৫৯০ ডলারে রফতানি করছে, আগের সপ্তাহে যা ছিল ৫৯৮ ডলার। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম কমেছে লক্ষণীয় মাত্রায়।
দাম কমার কারণ হিসেবে দেশটির ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্প্রতি থাই চালের চাহিদা দুর্বল হয়ে এসেছে। তার ওপর স্থানীয় মুদ্রা বাতের বিনিময় হারও কমেছে। ফলে অন্য মুদ্রার ক্রেতাদের কাছে সাশ্রয়ী হয়েছে থাই চাল। তবে ইন্দোনেশিয়া থেকে এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্রয়াদেশ আসছে বলেও জানান তারা।
এদিকে ভিয়েতনামিজ চালের দাম গত সপ্তাহের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশটি প্রতি টন ৫ শতাংশ ভাঙা চাল রফতানি করছে ৫৯০-৫৯৫ ডলারে। সেখানকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভিয়েতনামিজ চাল বর্তমানে তুলনামূলক সাশ্রয়ী। মৌসুম শেষে স্থানীয় বাজারে নতুন সরবরাহ আসতে যাচ্ছে। তাছাড়া আগের মৌসুমের মজুদও অবশিষ্ট আছে।
মার্কিন কৃষি বিভাগ সম্প্রতি এক পূর্বাভাসে জানায়, স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে চলতি বছর চাল আমদানি কমিয়ে দিতে পারে ফিলিপাইন। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর রফতানিকারকরা কৃষকদের থেকে চাল ক্রয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেন। ফিলিপাইন ভিয়েতনামিজ চালের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। দেশটি আমদানি কমালে এ চালের চাহিদা আরো কমে যেতে পারে।
সমাপ্ত ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের তীব্র সরবরাহ সংকট ছিল। নতুন বছরের প্রথম দিকেও এ সংকট অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে এশিয়াসহ বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যটির দাম নতুন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য বলছে, গত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। শস্যটির দামে এমন উল্লম্ফনের কারণে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এশিয়া ও আফ্রিকায় অনেক নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের অর্থনীতিতে বাড়ছে ঝুঁকি।
বিশ্ববাজারে চালের সরবরাহ সংকটের পেছনে অনেকগুলো বিষয়কে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। এল নিনোর কারণে আবহাওয়ার অপ্রত্যাশিত আচরণ খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। কোথাও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, আবার কোথাও খরা ব্যাহত করছে শস্যটির আবাদ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া।
ভারত গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশটির সরকার পণ্যটির রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করে। ওই সময় বাসমতী ছাড়া সব ধরনের সাদা চাল রফতানিতে দেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। স্থানীয় সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতেই এ রফতানি নীতি গ্রহণ করে নয়াদিল্লি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে শস্যটির সরবরাহ সংকট দেখা দেয়।
বিশ্বের কয়েকশ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। শস্যটির এমন মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। গৃহস্থালির নিত্যদিনের ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর অনেক পরিবার।
২০২৩-২৪ মৌসুমে চালের বৈশ্বিক উৎপাদন পূর্বাভাস আগের মতোই অপরিবর্তিত রেখেছে আইজিসি। উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫১ কোটি ১০ লাখ টন। শস্যটির বাণিজ্য ও ব্যবহার পূর্বাভাসে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। এর মধ্যে বণিজ্য দাঁড়াতে পারে ৫ কোটি টনে। আর ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৫১ কোটি ৬০ লাখ টনে। মৌসুম শেষে মজুদ দাঁড়াতে পারে ১৬ কোটি ৬০ লাখ টনে।
লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিলের বিশ্লেষক পিটার ক্লাব বলেন, ‘নিকট ভবিষ্যতে বাজারে চালের সরবরাহ সংকট অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে ভারতের রফতানি নিষেধাজ্ঞা।’
তিনি আরো বলেন, ‘মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হবে আগামী এপ্রিলে। ঈদের আগে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মুসলমানদের মাঝে শস্যটির চাহিদা বাড়বে।’
ভারত আগামী এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখবে বলে মনে করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। কারণ ভোটার সমর্থন আদায় করে নিতে এ সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারত চাল রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপের পরই চাহিদার অনুপাতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। ফিলিপাইনে চালের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। ফিলিপাইনের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়াও শীর্ষস্থানীয় চাল আমদানিকারক। দেশটির সরকার চালের উৎপাদন বাড়াতে সেনাবাহিনীকে কৃষকদের সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছে।