দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না আসে, সেজন্য দুই বছর ধরেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রথম হাত দেয়া হয় দেশের আমদানি নিয়ন্ত্রণে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে দেশের আমদানি কমেছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরেও ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় আমদানি কমতে পারে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরের আমদানিকে ভিত্তি ধরলে, গত ও চলতি অর্থবছরে আমদানি হ্রাস পাবে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। এ দুই অর্থবছরের নিট আমদানি ব্যয় হ্রাসের হিসাবকে বিবেচনায় নিলেও সেটি দাঁড়ায় প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও গত তিন বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়েছে। বিনিময় হার নির্ধারণে নেয়া হয়েছে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি। দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে টাকা ও ডলারের অদলবদল পদ্ধতিও চালু করা হয়। ডলারের ওপর চাপ কমাতে ঘোষণা দেয়া হয় রুপি, ইউয়ান, রুবলের মতো মুদ্রায় লেনদেন চালুর। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে। প্রতিটি উদ্যোগ নেয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দাবি করা হয়েছিল এবার ক্ষয় বন্ধ হয়ে রিজার্ভ বাড়তে শুরু করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, গত ১৬ মে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩৯০ কোটি বা ২৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) ওইদিন রিজার্ভ ১৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার ছিল। এ দুই হিসাবের বাইরেও নিট রিজার্ভের হিসাব রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফকে জানানো সে হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও কম। যদিও ২০২১ সালের আগস্টে দেশের গ্রস রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকতে হয়। এখন প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় পরিশোধ করতে হচ্ছে। সে হিসাবে দেশের নিট রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি দায়ও পরিশোধ সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিকে যেকোনো দেশের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল মনে করেন, রিজার্ভের ক্ষয় ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নীতি গ্রহণে সময়ক্ষেপণ, অস্থিরতা ও আন্তরিকতার অভাবের ফল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই ডলারের বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটির ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এ কারণে দেশে অবৈধ হুন্ডির বড় বাজার তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ এখন নগদ ডলার সংস্থানের পাশাপাশি আমদানির জন্যও হুন্ডি কারবারিদের খোঁজে। অন্যদিকে ঋণের সুদহার বেঁধে রাখার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়া হয়েছে। সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তরিক ছিল না। এ কারণে রিজার্ভের ক্ষয় ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কভিডের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের আমদানি ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ সংকুচিত হয়। তার পরও ওই বছর দেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি বেড়ে ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি প্রায় ৩৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে। রেকর্ড পরিমাণ আমদানি দায় পরিশোধের চাপ এসে পড়ে দেশের রিজার্ভের ওপর। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরব হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার সংকট ও নানা শর্তের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ নেমে আসে ৭৫ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশের আমদানি হয়েছে ৪৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় ধরলে চলতি অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ ৬৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সে হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় আমদানি কমবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২০২১-২২-এর পর গত দুই অর্থবছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয় কমতে যাচ্ছে।
আমদানি দায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের রফতানি আয় যথাসময়ে প্রত্যাবাসিত হচ্ছে না। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশ থেকে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশ থেকে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। যদিও রফতানি হওয়া পণ্যের পুরো অর্থ দেশে আসছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, শুধু চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে অপ্রত্যাবাসিত রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) অপ্রত্যাবাসিত এ অর্থ নিট ট্রেড ক্রেডিট হিসাবে দেখানো হয়েছে।
রিজার্ভ বাড়াতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডলারের সঙ্গে টাকার অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার জমা রেখে টাকা নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ দিনের জন্য চালু করা এ সোয়াপ পদ্ধতিও রিজার্ভ বাড়াতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
ডলারের ওপর চাপ কমানোর কথা বলে ২০২৩ সালের ১১ জুলাই রুপিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চালু করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় আপাতত বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো রুপিতে এলসি দায় পরিশোধের সুযোগ পায়। এরপর গত ৪ ফেব্রুয়ারি আরটিজিএসের মাধ্যমে চীনা ইউয়ানে লেনদেনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার রাশিয়ার সঙ্গে রুবলে বাণিজ্য চালুর ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব প্রক্রিয়ার কোনোটিই জনপ্রিয় হতে পারেনি। ডলারের ওপর চাপও কমেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রুপি, ইউয়ান কিংবা রুবলে আমরা আয় করি না। আমরা আয় করি ডলারে। ভারত ও চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ৯০ শতাংশেরও বেশি। আমাদের কাছে যদি রুপি বা ইউয়ান না থাকে তাহলে এ ব্যবস্থা জনপ্রিয় হবে কীভাবে?’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ডলার সংকট কমানো ও রিজার্ভের ক্ষয় বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে অনেক উদ্যোগই নেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নিতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। এ কারণে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। বাজার পুরোপুরি স্থিতিশীল করতে হলে সুদহার ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলছেন, অর্থনীতির প্রয়োজনের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সময়েই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ক্রলিং পেগ নীতি চালুর মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হার বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। এতে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে লেনদেন বেড়েছে। চলতি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহও বেশ ভালো। বিনিময় হার বাড়ায় রফতানি আয়ও বাড়বে। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়লে রিজার্ভের ওপর চাপ কমে আসবে।’