খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পুনঃ তফসিলের নীতি উদার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর পলাতক আব্দুর রউফ তালুকদারের সেই উদার নীতির কারণে পুনঃ তফসিল করা ঋণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। শুধু ২০২৩ সালেই ব্যাংকগুলোর পুনঃ তফসিল করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক বছরের হিসাবে এ যাবৎকালের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
গত বছর শেষে ব্যাংক খাতের পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের ১৮.৭৫ শতাংশ। ব্যাংকাররা বলছেন, সে সময় পুনঃ তফসিল করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হতে শুরু করেছে।
রবিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ব্যাংকগুলো ৫২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিল করে।পরের বছর ২০২০ সালে পুনঃ তফসিল কম হয়। ওই বছর খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয় ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে করা হয় ২৬ হাজার ৮১০ কোটি, ২০২২ সালে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি এবং ২০২৩ সালে ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে পুনঃ তফসিল ঋণ বেড়েছে ৪৩.১৫ শতাংশ।
গত বছর পুনঃ তফসিল ঋণ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়নীতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচনে প্রার্থী হতে গত বছরের শেষ দিকে অনেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত হন। এ ছাড়া বছর শেষে নিজেদের আর্থিক হিসাব ভালো দেখাতেও শেষ প্রান্তিকে অনেক খেলাপি গ্রাহকের ঋণ উদারভাবে নবায়ন করে ব্যাংকগুলো। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়।
যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে বিবেচিত হন, নয়তো প্রার্থী হতে পারেন না। সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সে সময় বাছবিচার ছাড়াই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। কারণ, ২০২২ সালের জুলাইয়ে পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের পুরো ক্ষমতাই ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেয়। সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের নীতিমালাও শিথিল করা হয়।
যেমন—ঋণ নিয়মিত করতে এখন ২.৫ শতাংশ থেকে ৪.৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হয়। আগে এই হার ছিল ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে পাঁচ থেকে আট বছর, যা আগে সর্বোচ্চ তিন বছর ছিল। এ ছাড়া, বিশেষ বিবেচনায় কোনো খেলাপি ঋণ চারবার পর্যন্ত পুনঃ তফসিলের সুযোগ রাখা হয়েছে। আগে তিনবারের বেশি পুনঃ তফসিল করা যেত না। এ ছাড়া, ব্যাংকের পর্ষদই এখন খেলাপি ঋণ নবায়নের সিদ্ধান্ত দিতে পারছে। ব্যাংকগুলোর হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় খেলাপি ঋণ নবায়নও বেড়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বারবার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলে ছাড় দেওয়াটা ইতিবাচক কিছু বয়ে আনছে না। উল্টো যে ঋণগুলো পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধে টালবাহানায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে পুনঃ তফসিল করা ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি, ২০২১ সালে এক লাখ ৬৮ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০২০ সালে এক লাখ ৫৫ হাজার ৬৩০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা।
পুনঃ তফসিল বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ফুড সেফটি মুভমেন্টকে বলেন, বছর শেষে খেলাপি ঋণ কমানোর একটা চাপ থাকে। কারণ বুক ক্লিন করার জন্য ব্যাংকগুলো নগদ আদায়ে জোর দেওয়ার পাশাপাশি পুনঃ তফসিলে ঝোঁকে। এটা প্রতিবছরই হয়ে থাকে। তাই গত বছর রেকর্ড খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফুড সেফটি মুভমেন্টকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেশি পুনঃ তফসিল হয়েছে। কারণ, আমাদের দেশের অনেক নেতাই ঋণখেলাপি। নির্বাচনের আগে অনেক প্রার্থী ঋণ নবায়ন করেন। এর প্রভাবে পুরো বছরের চিত্র অস্বাভাবিক হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন। ২০২৩ সাল শেষে পুনঃ তফসিল করা ঋণ স্থিতির ২৬.৪ শতাংশই ছিল শিল্প খাতের। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের উদ্যোক্তারা ২০.৯ শতাংশ ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন। এ ছাড়া পুনঃ তফসিল করা ঋণের ১১.৩ শতাংশ চলতি মূলধন, ব্যাবসায়িক ১১ শতাংশ, আমদানি ৮.৭ শতাংশ, ৬.৫ শতাংশ নির্মাণ, ৫.২ শতাংশ কৃষি খাতে এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য খাতে।
পুনঃতফসিল বলতে, সাধারণত ঋণ পরিশোধের সময়সীমাকে পিছিয়ে দেওয়া বোঝায়। পুনঃ তফসিল করা ঋণকে ‘স্টেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আইএমএফ।